পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল সহ এক শ্রেণির নেতার বেলাগাম দুর্নীতিতে যখন ধূলিমলিন হয়ে পড়েছে তৃণমূলের ভাবমূর্তি, তখন কঠিন ও কঠোর আর্থিক সংস্কারের পথে পা বাড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১১ বছর পর এই প্রথম এত বড় সংস্কারে হাত দিলেন দিদি।
সেটা কী?
তা হল, পঞ্চায়েত স্তরে চুরি ও এক শ্রেণির নেতার করে খাওয়া বন্ধ করা। এবং দুই, প্রান্তিক ও গরিব মানুষের হাতে তাঁদের পাওনা গণ্ডার টাকা ষোল আনা পৌঁছে দেওয়া।
এ জন্য কী পদক্ষেপ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
• ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের কাজ দেখভাল করার জন্য অফিসারদের দায়িত্ব দিতে চলেছে নবান্ন। এ ব্যাপারে পঞ্চায়েত আইনের আওতায় ২০০৪ সালে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল (No. 3244/PN/O/V3C-11/98 dated 2010912004)। সেই নির্দেশ ফের বলবত্ করা হবে।
• শুক্রবার অর্থাত্ ২ সেপ্টেম্বর এই মর্মে নয়া বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক ডিভিশনাল কমিশনার একটি জেলা পরিষদে মাসে একবার গিয়ে কাজের হিসাব নেবেন। জেলা শাসকদের প্রতি মাসে একটি করে পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতে পরিদর্শনে যেতে হবে। আর প্রতিটি বিডিওকে মাসে তিনটে করে গ্রাম পঞ্চায়েতে গিয়ে কাজের হিসাব চাইতে হবে।
• নবান্ন সূত্র জানাচ্ছে, এই পদক্ষেপের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হল ভুয়ো কাজ বা ভুয়ো খরচ বন্ধ করা। অনেক সময়েই খাতায়কলমে যে কাজ দেখানো হয় বাস্তবে তা হয় না। এ বার প্রতিটি পয়সার হিসাব চাওয়া হবে।
• পঞ্চায়েতে ভুয়ো কাজ বন্ধের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের কাছে তাঁদের হকের টাকা পৌঁছে দিতে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার ব্যবস্থাকে আরও আঁটোসাটো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
• ডাইরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের জন্য বর্তমানে রাজ্যে একটি পোর্টাল রয়েছে। তার নাম জয় বাংলা পোর্টাল। সেখানে নাম নথিভুক্ত করে পেনশন ইত্যাদি পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি বাতিল করে গোটা রাজ্যে অভিন্ন একটি ক্যাশ ট্রান্সফার পোর্টাল বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ব্যাপারে চার জন অফিসারকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছেন একজন আইএএস অফিসার। তা ছাড়া মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে মাথায় রেখে একটি ১৪ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটিও গড়ে দেওয়া হয়েছে এ জন্য।
নবান্নের একটি সূত্রের দাবি, এর নেপথ্যে কেন্দ্রের গুঁতোও একটা কারণ। কেন্দ্রের অনুদানে চলা প্রকল্পের টাকা একাংশ পঞ্চায়েতে লুঠ হয়েছে বলে অভিযোগ। হিসাবে গরমিল থাকায় কেন্দ্র তাই সাময়িক ভাবে বরাদ্দ দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।
নবান্নের ওই কর্তার কথায়, কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ রাজ্যের সামনেও নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই কালক্ষেপ না করেই সংস্কারে হাত দিয়েছেন। এ হেন সংস্কার বাংলায় গত বিশ বছরে হয়নি। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল, সরকারি কোষাগারের টাকার অপচয় বন্ধ করা। সেই সঙ্গে গ্রামের মানুষকে তা প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দেওয়া।
বস্তুত গ্রাম ও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে তৃণমূলের জনভিত্তি মজবুত। কিন্তু অতীতে দেখা গিয়েছে, আমফানের ত্রাণের টাকা লুঠ বা পঞ্চায়েতে একাংশ নেতার কাটমানির খাওয়ার প্রবণতার কারণে তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর তাই দুর্বল হয়েছে তৃণমূল। সূত্রের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, মানুষকে ফের তাঁর অধিকার বুঝিয়ে দিতে পারলে চলতি ঝড়ও মোকাবিলা করা যাবে। অর্থাত্ একাংশ নেতার দুর্নীতির জন্য তৃণমূলের ভাবমূর্তিতে যে আঁচ পড়েছে তা থেকে ফের আলোর পথে হাঁটা যাবে। এখন চ্যালেঞ্জ একটাই, তা হল কত দ্রুত এই সংস্কার বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে। নবান্ন সূত্রের মতে, গত সপ্তাহ খানেকের কাজের গতি দেখলেই বোঝা যাবে এ ব্যাপারে কোনও বিলম্ব চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রী। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একদা যেমন বলেছিলেন ডু ইট নাও, এখন এ ব্যাপারে নবান্নের চোদ্দ তলার মনোভাবও তাই।