নন্দীগ্রামে ম্যাচ শুরু করেছিলেন শুভেন্দু, শেষ বাঁশি বাজালেন মমতা!

হলদি নদীর চরে সূর্যের তেরচা আলোটা যখন সবে পড়তে শুরু করেছে, তার কিছুক্ষন পরেই রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। দিনের প্রথমার্ধটা নিয়তি বরাদ্দ রেখেছিল তাঁর জন্য। দ্বিতীয়ার্ধে সব আলো শুষে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়ালে হেস্তনেস্ত সেরে সোনাচূড়ার সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করে অবশেষে রেয়াপাড়ার অস্থায়ী  বাড়িতে ফিরলেন তিনি। বিকেল পাঁচটার হিসেবে নন্দীগ্রামে ভোট পড়ল ৮০.৭৯ শতাংশ।

এ দিন প্যাভিলিয়নে ফেরার আগে মমতার শেষ গন্তব্য ছিল সোনাচূড়া। অভিযোগ সোনাচূড়ার পূর্ব উসমানচকের ২২৩ ও ২২৪ নম্বর বুথ এলাকা  থেকে  দুজন যুবককে তুলে নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী।  শেখ হানিফ ও শেখ শাহরুফ নাম ওই দুই যুবকের।   তৃণমূল নেত্রী খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছলে গ্রামবাসীরা তাঁকে অভিযোগ জানান। বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর অস্থায়ী ঠিকানায় ফেরা, এখান থেকেই আগামিকাল উত্তরবঙ্গ রওনা দেবেন মমতা।

তীব্র তাপপ্রবাহ, আর্দ্রতাজনিত অস্বস্তি, ছোটখাটো বিক্ষিপ্ত ঝামেলার পরেও নন্দীগ্রামের ভোট উৎসবে  ব্যাপক পরিমাণ  ভোটারের সক্রিয় উপস্থিতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শুভেন্দু অধিকারী দিনের বেলাতেই বলে রেখেছিলেন, তিনি আশা করছেন ৮৫  শতাংশ ভোট পড়বে এবং যদি তা হয় তবে মনে করতে হবে মানুষও পরিবর্তনের পরিবর্তন চাইছে। শুভেন্দুর কথা আক্ষরিক ফলেনি ঠিকই, তবে ৮০ শতাংশের বেশি ভোটদান নন্দীগ্রামের নিরিখে বিরলই। নন্দীগ্রামের মোট ভোটার ২ লক্ষ  ৫৭হাজার ১৫৬ জন। পরিসংখ্যান বলছে ভোট দিয়েছেন ২ লক্ষ ৫ হাজারের বেশি মানুষ। তাহলে কি শুভেন্দুর কথাই ফলবে?

পর্যবেক্ষকরা বলছেন শুভেন্দুৃ-মমতা দুজনেই স্টার পাওয়া ক্যান্ডিডেট। কাউকেই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না এ ক্ষেত্রে। এক কথায় বললে লড়াই হা়ড্ডাহাড্ডি। শুভেন্দু অধিকারী যদি জেতেন তবে তিনি জিতবেন মেরুকরণ তাসে, একথা বলাই যায়।

অন্যদিকে এবার প্রথম থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল নির্ভর করে আসছিলেন মহিলা এবং যুবভোটে। আর ময়দানি প্রতিবেদকরা বলছেন, নন্দীগ্রামে আজ মহিলা ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ফলে শুভেন্দু অধিকারীর অস্ত্র যদি হয় মোট ভোট থোকে সংখ্যালঘু ভোট সরিয়ে বাকিটা ঝুলিতে ভরা, মমতার তাস তবে মোট ভোট থেকে সংখ্যালঘু ও মহিলা ভোটের নিটফল। সেক্ষেত্রে কার ঘরে কী ফসল জমা পড়বে তা সময় বলবে। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিনের শেষে বয়ালে গিয়ে মাস্টারস্ট্রোক দিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ যেন দাবার দান, কচ্ছপগতিতে এগোতে এগোতে হঠাৎ কিস্তিমাত।

এদিন দুপুর একটা নাগাদ মমতা বেরোন রেয়াপাড়ার বাড়ি থেকে। সোজা চলে যান বয়ালের ৭ নং বুথে। এখান থেকে সারাদিন ধরে বুথ লুটের অভিযোগ এসেছে। ৩৫৫টি বুথের মধ্যে একটি বুথ, কী বা এসে যায়! কিন্তু মমতা সুযোগটাকে ব্যাবহার করলেন, দুঘণ্টা বসে রইলেন এক জায়গায়, অনেকটা তাঁর সুপরিচিত ধর্ণার কায়দায়। বাইরে তখন দুপক্ষের মধ্যে রণক্ষেত্র। মমতা ওখান থেকে কথা বললেন রাজ্যপালের সঙ্গেও। দায়িত্বে থাকা আইপিএস-এর সঙ্গে কথাও বললেন। বাকি সময়টা নিশ্চিন্তে ভোট হবে এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে তবে ছাড়লেন বয়ালের মাটি। এর মধ্যে দিয়ে ভোটাররা যেমন চাঙ্গা হল, তেমনই মমতার প্রতিটি অভিযোগ সর্বভারতীয় গণমাধ্যমের আলো পেল, সারাদিন ধরে বুথে বুথে ঘুরলে অবশ্য এই প্রচার পেতেন না মমতা।

এই প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ থেকে যায় একজনের কথা না বললে, আজকের নাট্যে তিনিও হেভিওয়েট কুশীলব। তিনি নন্দীগ্রামের দায়িত্বে থাকা আইপিএস নগেন্দ্র ত্রিপাঠী। বয়ালে বাইরে যখন প্রায় খণ্ডযুদ্ধের পরিস্থিতি বুথে বসে মমতা কথা বলেন নগেন্দ্র ত্রিপাঠীর সঙ্গে। মমতা  তাঁকে প্রশ্ন করেন,”আগে এখান থেকে লোক সরাও। তারপর আমি এই জায়গা ছাড়ব। তোমাকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাহলে এই অবস্থা কেন?” নগেন্দ্র ত্রিপাঠী উত্তরে বলেন, “আমি নিশ্চিত করছি আর কোনও অশান্তি হবে না, আপনি চেক করতে পারেন।” এই সময়ে জেলা পুলিশ সুপার সুনীল যাদবও চলে আসেন আসেন। মমতা তাঁকেও প্রশ্ন করেন, “সকাল থেকে এই কেন্দ্র থেকে একাধিক অভিযোগ করা হলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?”নগেন ত্রিপাঠী কথাবার্তার মধ্যেই  উর্দি দেখিয়ে বলেন, “ম্যাডাম খাকি উর্দিতে দাগ নেবো না,  আর এমন অশান্তি হবে না।” মমতা বলেন,”অনেকেই তো দাগ নিচ্ছে”,  নগেন্দ্রর সপাট উত্তর-“আমি দাগ নেবো না।” মমতা এই বাক্যটা শুনে রওনা হলেন পরের গন্তব্যে। আরও ছয় দফা ভোট হবে, কারও আঙুলে লাগবে ভোটের কালির ছিটে, না চাইতেও কোথাও কোথাও লেগে থাকতে পারে রক্তের দাগ, তবে এই আপ্তবাক্য- আমি দাগ নেবো না, জেগে থাকবে আরও বেশিদিন, হয়তো চিরদিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here