পুজো ও যজ্ঞ সহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুভ সূচনা হলো উত্তরপূর্ব ভারতের বৃহত্তম রাস মেলার

কোচবিহার: বাবা মদনমোহনের পুজো ও যজ্ঞের মধ্য দিয়ে শুরু হল উত্তরপূর্ব ভারতের বৃহত্তম রাস মেলা। প্রতিবারের মত এবারও কোচবিহারের এই রাস উৎসবে জমা হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু এই মেলা নিয়ে আছে পুরনো গল্প-গাথা। কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ন এই মন্দিরের উদ্বোধন করেন। কোচবিহারের এই রাসমেলা প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। জনশ্রুতি আছে এই মেলা প্রথম শুরু করেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ কোচবিহারের ভেটাগুড়িতে। পরবর্তীকালে এই মেলার স্থান পরিবর্তন হয়।

কোচবিহারের এই মদনমোহন মন্দিরে পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। একেক কক্ষে একেক দেবীর বিগ্রহ। পূর্ব প্রান্তে জয়তারা। পশ্চিম প্রান্তে কালী বিগ্রহ। আরেক পাশে ভবানী বিগ্রহ। অন্যদিকে নাটমন্দির। নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো বা জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। মন্দিরের পাশেই পুষ্করিণী বৈরাগীদীঘি। আগে এই পুকুরেই সেবাইত বা ভক্তরা স্নান করতেন। তাঁদের জন্য থাকত বিশেষ তাঁবুর ব্যবস্থা। এখন তাঁদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আনন্দময়ী ধর্মশালা। মন্দিরে মূল বিগ্রহের কক্ষ হল মদনমোহনের। বিগ্রহটি রুপোর তৈরি। চাদোলাতে রাখা হয়েছে বাবা মদনমোহনকে। সেই চাদোলার চারদিকে চারটে কোণ। বিগ্রহ বলতে দুটি, একটি বড় মদনমোহন, আরেকটি ছোট মদনমোহন মন্দির। ছোট মদনমোহন অন্তরালেই থাকে। একবারই তিনি জেগে ওঠেন। সেটা হল এই রাস উৎসবের রাস পূর্ণিমার সময়। এখন মদনমোহন মন্দির দেবোত্তর ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত। আর রাস মেলা পরিচালিত হয় কোচবিহারের পুরসভার মাধ্যমে। তবে কোচবিহার জেলায় এই মদনমোহন মন্দির আরও আছে। যেমন দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, মেখলিগঞ্জ ও তুফানগঞ্জ। পুজোও হয় সেসব স্থানে। কিন্তু পুজো ঘিরে এত বড় মেলার আয়োজন হয় শুধুমাত্র এই মন্দির ঘিরেই।রাজবংশের আদি দেবতা হলেন মদনমোহন। বছর পুরনো এই মেলা মদনমোহনের পুজো ও যজ্ঞ দিয়ে মেলা শুরু হয়। পনেরো দিন ধরে চলে এই মেলা। একসময় রাজারা পুজো দিয়ে রাসচক্র ঘোরাতেন, এখন রাজারা নেই। তাঁর পরিবর্তে দেবোত্তর ট্রাস্টের সভাপতি হিসাবে জেলা শাসকেরা পুজো দিয়ে রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা করেন। এখানকার মানুষদের বিশ্বাস এই পুজো করা হয় জেলার মঙ্গলকামনার জন্য।

প্রতিবছর রাস উৎসব ও মেলায় উতরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি ভুটান, অসম থেকেও প্রচুর মানুষ আসেন। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই রাস মেলায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। উল্লেখ্য , আগে অনেকেই গরুর গাড়িতে চেপে এই মেলায় আসতেন। এখন আর তা দেখা যায় না। আগে খুব দইচিড়া পাওয়া যেত। এখন তার জায়গা দখল নিয়েছে ফার্স্ট ফুড। রাস চক্র ঘিরে আর একটি বড় বার্তা হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। রাসচক্র তৈরি করেন আলতাফ মিঞা। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে চক্র তৈরির কাজ শুরু হয়। বাঁশ দিয়ে বাতা তৈরি করা হয়। বাঁশ শুকিয়ে গেলে তাতে কাগজের কারুকাজ করা হয়। পাট দিয়ে গড়া দেব দেবীর ছবিও আটকানো হয় চক্রের মধ্যে। ২২ ফুট উঁচু এই রাসচক্র। রাস মেলার আর একটি আকর্ষণ পুতনা রাক্ষসীর মূর্তি। রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন গল্প মূর্তির মডেলে তৈরি করা হয়। মেলায় জিলিপির বেশ আকর্ষণ। ভেটাগুড়ির জিলিপি আর বাবুহাটের জিলিপির মধ্যে লড়াই হয়। ঘানি ঘুরিয়ে তেল বের করার মেশিন নিয়েও লোকজন বসেন। হস্তশিল্পের অনেক স্টল বসে মেলায়। সেখানে মেখলিগঞ্জের মেখলি যেমন আছে তেমনই শিতলখুচির শীতল পাটিও পাওয়া যায়। মেলার দিন যত গড়ায় ততই মেলায় ভিড় বাড়তে থাকে। আগে এই মেলায় পাওয়া যেত মাটির পুতুল, মাটির অনেক সামগ্রী  এছাড়া লোহার সামগ্রী থেকে শুরু করে ধান ভাঙ্গার মেশিনও। মেলা ছাড়ারও এই সময় দর্শনার্থীরা ভিড় জমায় মধুপুরের শঙ্কর দেবের সমাধি মন্দিরে।

জানা গিয়েছে, আগে মেলা উপলক্ষে অনেক স্পেশাল ট্রেন দেওয়া হতো। বাংলাদেশের গিতালদহ থেকে আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত এই ট্রেন চলত। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা গরুর গাড়ির পরিচয় পাওয়া যেত ভিন্ন ঘণ্টা ও তার আওয়াজ শুনে। এখন অবশ্য গরুগাড়ি দেখা যায় না। তবে মেলা আছে মেলার জায়গাতেই। পরিবর্তন থাকলেও মেলার ঐতিহ্য আজও অটুট। সেই রাস মেলার শুভ সূচনা হয়ে গেলো শুক্রবার সানাইয়ের সুরে, পুজো ও যজ্ঞের মধ্য দিয়ে। এই পুজো দেখতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here